
- নিমঃ একটি অধুনা “ফুড কনফারেন্স”
মুহাম্মাদ জয়নাল আবেদীন
প্রথমেই বলে রাখি বইটির কোনো পর্যালোচনা লিখতে চাচ্ছিলাম না।কারন লেখককে আমার মেন্টর মানি।কিন্তু বইটি পড়ার পর বইটার সম্পর্কে না লিখে পারলাম না।এবার মূল কথায় আসি সাহিত্য হলো সামাজিক বাস্তবিক আয়না। সাহিত্যের সকল শাখায় লিখলেও কেউ কেউ রম্য সাহিত্য বা স্যাটায়ার লেখার সাহস করে উঠতে পারেন না।যেমনটি পেরেছিলেন আহমদ ছফা “গাভী বিত্তান্ত”তে এবং আবুল মনসুর আহমদ “আয়না” ও “ফুড কনফারেন্স”। স্যাটায়ার বা রম্য সাহিত্য হচ্ছে অন্যায়কে
ব্যাঙ্গ করে বর্ণনা করা তবে সেটা কৌতুক নয়। “নিম”সেটা করেছে।
বইটিতে তিনটে গল্প আছে।যথাক্রমে নিভৃতচারী মহাজন, নির্বোধের মহামানুষ এবং নিদ্রাবস্থায় মননাদেশ।
আলোচনা শুরু করি “নিদ্রাবস্থায় মননাদেশ” গল্প থেকে।
একটি দেশের সামগ্রিক অবস্থা সে দেশের মানুষের সামগ্রিক ভালমন্দ দেখেই বিচার হয়। এদেশ কতটা ভাল আছে সেটাই বোধহয় লেখক গল্পের শুরুতে বলছেন,
“একটু থেমে সামনে তাকাতেই দেখি নদী মরে খাল হয়ে গেছে।তার পানি লাল।দেখে মনে হয় তাজা রক্ত।”
যে দেশের নদী মরে খাল হয়ে গেছে মানুষের তাজা রক্তে,সে দেশের কি অবস্থা সচেতন নাগরিক মাত্রই তা বুঝতে পারে।আর দেশটা যে কোন টা সেটা নাই বা বললাম। আচ্ছা লেখক কেন মরা নদীর কথা বলতে গেলেন? মূলত রূপক অর্থেই বলেছেন। যেভাবে সোনার দেশে দুর্নীতি,অত্যাচার, অনাচার বেড়ে চলছে তাতে এই সোনার দেশটা মানুষের তাজা রক্তে ভর্তি মরা নদীতে পরিণত হতে সময় নিবে না।
লেখক একটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা রূপক উপমা ব্যবহার করছেন, যেটা সরাসরি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। লেখক বলছেন,
“এই খাল হয়ে যাওয়া রক্তের নদী পেরুতে হবে, পেছনে হায়েনার দল। কিছু দূরেই দেখতে পেলাম নৌকার মতো কিছু একটা ভাসছে। দ্রুত পায়ে কাছে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি কলাগাছের ভেলা। ধানের গাছ দিয়ে নৌকার স্ট্রাকচারে সাজানো। ধানের শিশ এমনভাবে রাখা যেনো রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী। দূর থেকে দেখে তাই বিভ্রম হয়েছে। ভেলা হোক আর কোলা, এই রক্তের খাল হয়ে যাওয়া নদী পেরুতেই হবে। লাফ দিয়ে ভেলায় চড়ে বসলাম। ভেলা যে ভাসিয়ে নেবো ওপারে তার তো কিছুই নাই। ইতিউতি চেয়ে দেখি একটা লাঙ্গল রাখা। আস্ত লাঙ্গল আবার ভারী বেশি, এটা দিয়ে চালানো সম্ভব না। হঠাৎ মাথায় খেয়াল এলো, লাঙ্গলটা দুইভাগ করে নিলে উপরের হাতল টাইপ ওটা দিয়ে বৈঠার কাজ চালানো যাবে। কিন্তু লাঙ্গলের খিল খুলবো কিভাবে?”
সচেতন পাঠক বুঝতে পারছেন আসল সমস্যা কোন জায়গায়। এই গল্পটা পুরোটাই দেশও মাতৃকা নিয়েই লেখা।এদেশের এমপি মন্ত্রীরা কি করে, কিভাবে দুর্নীতি করে এবং জনগণ কে কিভাবে বোকা বানায় তার সবটুকুই কাল্পনিক বর্ণনায় বর্ণিত আছে। যদিও লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু সেটা বাস্তবতা থেকেই নেওয়া।
এবার দ্বিতীয় গল্প অর্থাৎ “নির্বোধের মহামানুষ”এর ব্যাপারটা দেখা যাক।গল্পের নামেই লেখক বাজিমাৎ করে ফেলেছেন শতভাগ। কারন নির্বোধের মহামানুষ হয় সমাজের ধোঁকাবাজ এবং বাটপাররা। গল্পটি একটা ভন্ডপীরের। কিভাবে পরস্পর বিপরীত ধরণের মানুষও স্বার্থের জন্য এক হয়ে যায় তার বাস্তব উদাহরণ এই গল্প। যদিও সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ “লালসালু” এবং “বহিপীর” নামে দুটো বই লিখেছেন তবুও এই গল্পের বিশেষত হলো গল্পের আধুনিক ধর্মীয় ইজতিহাদের বয়ান। আমাদের আধুনিক সমাজে দরবার শরীফ, পীর খানকা শরীফ কমে গেলেও নতুন নতুন তৈরী হচ্ছে এবং আধুনিক বিজ্ঞানের কারিশমা দেখিয়ে সরলমনা মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই গল্পটা সেই কথায় বলছে। শুধু তাই নয় কেন আমরা শর্টকাট জান্নাত পেতে চাই, সে ভারী বিষয় গুলো সহজাত ভঙ্গিমায় লিখেছেন লেখক। আর লেখক এখানেই স্বার্থক।মোবারক র্যালী,আহলে হাদীস, সালাফী, লা মাযহাবীসহ বিভিন্ন মানহায নিয়েও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি গল্পের সারল্যে বয়ান করার চেষ্টা করেছেন।
মানুষ কেন ভয় পায়?কেন পীর ধরে এবং কেন এর বাজার।তার একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিম্নোক্ত প্যারায়,
“মানুষের ভেতরে পাপের বড়ো বড়ো আবর্জনার স্তূপ। যার পাপ যতো বেশি তার ভয় ততো বেশি। এই ভয় কে পুঁজি করেই এই পুরা এলাকা জয় করে নিয়েছি। সৎ মানুষের ভয় নাই। দুনিয়াতে সৎ মানুষের অভাব তাই আমাদের বাজার বড়ো।”
“নিদ্রাবস্থায় মননাদেশ” গল্পটি দেশের কথা বলেছে।”নির্বোধের মহামানুষ”গল্পটি সামাজিক অবক্ষয় এবং বইটির প্রথম গল্প অর্থাৎ “নিভৃতচারী মহাজন”গল্পটিতে লেখক শ্রেণির ভণ্ডামির মুখোশ উম্মোচন করেছেন,সাথে সাংবাদিকতার মুখোশও। শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে লেখক এবং সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হয় সমাজ পরিবর্তনে।এরা যদি কর্মক্ষেত্রে সৎ হয় তবে সমাজের অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে।কিন্তু বর্তমান ঘটছে উল্টো। লেখক টাকার জন্য উল্টোপাল্টা লিখছেন। সাংবাদিক দুই পয়সার জন্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
“গল্পের গরু গাছে উঠে” বলে একটা প্রবাদ আছে।আমাদের লেখকদের অবস্থা হয়েছে তাই। গল্প, উপন্যাস কবিতার নামে যা ইচ্ছা তাই খাওয়াতে চাচ্ছেন। এবং এক শ্রেণির ন্যাকা পাঠক খাচ্ছেও। যার জন্য সেই সব লেখক বুক ফুলিয়ে অগ্রজ কবি সাহিত্যিকদের অস্বীকার ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারছে। “নিভৃতচারী মহাজন “গল্পটি তাদের নিয়েই। গল্পটি পড়লে পাঠক ধরতে পারবেন কার বা কাদের কথা লেখক বলতে চেয়েছেন।
লেখকের দুই তিনটা সংলাপ না বললে আলোচনাটি যুতসই হবে না। লেখক বলছেন,
“পাঠক ঢুকতে না পারলে পাঠকের ভেতর জোর করে গল্প হান্দাই দিতে হবে।”
আমাদের লেখকদের একটা চেষ্টা আছে গল্প উপন্যাসে আউল ফাউল ত্যানা পেচানোর।এবং বিনা কারনে ঢাউস আকারে বই লেখা।যেটা অনেক সময় পাঠকের বিরক্তির কারন হয়।সাথে সাথে গল্প উপন্যাসে সমাজের জন্য শিক্ষা বা সামাজিক বাস্তবিক উদাহরণ তুলে ধরতে চান না বা তুলে ধরা যে জরুরি সেটা বুঝেন না। সেটা দিকেই আলাকপাত করেছেন “নিম” এর লেখক।
নিভৃতচারী মহাজন, নির্বোধের মহামানুষ এবং নিদ্রাবস্থায় মননাদেশ গল্পত্রয়ে এই সমাজের শিক্ষিত সমাজের লেখক, সাংবাদিক, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং দেশের রাজনৈতিক হর্তাকর্তাদের কথা বলা হলেও। আদতে আমার আপনার কথা বলার চেষ্টা করছেন। সেটা সচেতন পাঠকমহলে গৃহীত হবে বলেই বিশ্বাস করছি।
শিরোনামে আবুল মনসুর আহমদের “ফুড কনফারেন্স” এর সাথে একটা তুলনা দিতে চেয়েছি। মূলত তৎকালীন সময় আবুল মনসুর আহমদ “ফুড কনফারেন্স” এ যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সমাজের হর্তাকর্তাদের বাস্তবিক অবস্থা বর্ণনায় যে সুনিপুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। “নিম” এর লেখক সাখাওয়াত হোসেন সাকিল সেই চেষ্টায় করেছেন। যতদিন পর্যন্ত এজাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি হবে ততদিন পর্যন্ত বলা যায় যে,”সাহিত্য সমাজের দর্পণ”।