
সৌদি আরবে কাজের সন্ধানে যাওয়া অসংখ্য বাংলাদেশি শ্রমিক প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে নিয়োগকর্তাদের চরম অবহেলা ও অমানবিক পরিবেশের কারণে। সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং ফেয়ার স্কয়ারের এক যৌথ তদন্তে উঠে এসেছে এই মর্মান্তিক চিত্র, যা প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনযাত্রার নিষ্ঠুর বাস্তবতা উন্মোচন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুর পেছনে মূল কারণ হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া, নির্মাণস্থল থেকে পড়ে যাওয়া বা সড়ক দুর্ঘটনার মতো ঘটনায় প্রতি বছর বহু শ্রমিক প্রাণ হারাচ্ছেন। তবে এসব মৃত্যুর সঠিক তদন্ত না করে প্রায়শই তা “প্রাকৃতিক মৃত্যু” বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, যা নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করছে।
২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের সময় শ্রমিক অধিকার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর সংশোধনমূলক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরব, যারা ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তারা এখনও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেনি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বিশ্বকাপের জন্য দ্রুতগতিতে নির্মাণকাজ চলাকালীন আরও বেশি শ্রমিকের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
সৌদি আরবের “ভিশন ২০৩০” প্রকল্পের আওতায় দেশটিতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণের তাড়ায় শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা উপেক্ষিত হচ্ছে। ন্যূনতম মজুরি, কাজের নিরাপদ পরিবেশ বা স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক সুবিধাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জোর দাবি জানিয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই শ্রমিকদের জীবনমূল্য দিয়ে উন্নয়নের পথ চলা বন্ধ করতে হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের পরিচালক মিনকি ওর্ডেন বলেন, “ফিফা এবং সৌদি সরকারের দায়িত্ব শুধু স্টেডিয়াম নির্মাণ নয়, শ্রমিকদের রক্ষা করা। কাতারের মতো এখানেও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রয়োজন।”
অনেক বাংলাদেশি পরিবার তাদের স্বজনদের মৃত্যুর সত্যিকার কারণ জানতেই পারছে না। দূতাবাস এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেও সঠিক তদন্ত বা ন্যায়বিচার মিলছে না। ফলে শোকের বোঝা বয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি আর্থিক সংকটেও পড়তে হচ্ছে তাদের।
সমাধানের পথ কী?
১. নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা: শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২. মৃত্যুর তদন্তে স্বচ্ছতা: প্রতিটি মৃত্যুর কারণ স্বাধীনভাবে তদন্ত করে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
৩. আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি: ফিফা এবং অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে সৌদি সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
সৌদি আরবের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নেপথ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো প্রবাসী শ্রমিকের রক্ত, ঘাম এবং অশ্রু। তাদের মৃত্যু রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, বিশ্বকাপের মতো বড় আয়োজনেও মানবাধিকারের কালো ছায়া পড়বে। বাংলাদেশসহ শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলোর উচিত তাদের নাগরিকদের সুরক্ষায় জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো।