
উত্তর গাজার ধ্বংসস্তূপ আর ধুলোর আস্তরণের মাঝে, ১২ বছর বয়সী জানা মোহাম্মদ খলিল মুসলেহ আল-স্কেইফি এক নতুন মিশনে নেমেছে। তার হাতে দুটি বড় প্লাস্টিকের বালতি, আর জীবনের একটাই লক্ষ্য—নিজের অসুস্থ বাবা-মায়ের জন্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানি জোগাড় করা। চারদিকে ধ্বংসাবশেষ আর তীব্র মানবিক সংকটের মাঝেও এই কিশোরী হার মানতে রাজি নয়।
সিএনএন নিউজের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জানা গাজা সিটির ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে পানি ভর্তি বালতি হাতে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছে, যা গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরে।
এক বছর আগে ইসরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে জানার বড় ভাই মারা যাওয়ার পর থেকেই পরিবারের সব দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়েছে। বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ, তাই এই কিশোরীকেই তাদের দেখাশোনা করতে হয়। দীর্ঘ দিন ধরে কোনো ত্রাণ আসছে না এবং বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, জানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বালতি হাতে নিয়ে পানির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে—একটু পানির আশায়, যা দিয়ে সে তার অসুস্থ বাবা-মায়ের তৃষ্ণা মেটাবে। এরপর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে হয়তো সে নিজে পান করবে।
পানির লাইনে দাঁড়িয়ে জানা জানায়, “আমি চাই না আমার আব্বু-আম্মু কষ্ট থাকুক। তাই আমি শক্ত হবো, আব্বু যেন কষ্ট না পান। আমার আব্বু বয়স্ক, তার হার্টের সমস্যা আছে। তিনি যদি বালতি তুলতে যান, পড়ে যাবেন। তাই, আমি পানি আনতে বের হয়েছি।”
পানির বালতির ভারে তার আঙ্গুলের গাঁট সাদা হয়ে গেছে, আর মূল্যবান পানির ছিটেফোঁটায় তার জিন্সের প্যান্ট ভিজে উঠেছে। তার পরনে সিন্ডারেলা টি-শার্ট থাকলেও, কাল্পনিক সেই জীবন যেন তার জন্য কেবলই কল্পনা। খুব অল্প বয়সেই, পরিবারের এই বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, জানার ছোট্ট ভাগ্নি ক্ষুধার যন্ত্রণায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কোনো ওষুধ নেই, কোনো পুষ্টিকর খাবার নেই—শুধু একটি নিষ্পাপ শিশুর নিরন্তর কান্না, যা শেষ পর্যন্ত চিরতরে থেমে গেছে।
মূলত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় যে নৃশংস যুদ্ধ শুরু করে, তারপর থেকেই খাবার ও পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু গত ১১ সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল যখন থেকে সকল ধরনের সাহায্য সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে, তখন থেকেই পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এই মাসের শুরুতেই বলা হয়েছে, ২১ লাখ মানুষের বসতি গাজায় প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন এখন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। মানবসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে।
ইসরায়েল দাবি করছে যে, এই অবরোধ ও নতুন সামরিক অভিযান গাজায় আটকে থাকা জিম্মিদের মুক্ত করতে হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য। তবে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে দুর্ভিক্ষ ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে। গাজায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া গত কয়েক মাস ধরেই কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, ইসরায়েল পানি শোধন ও লবণাক্ততা দূরীকরণের সরঞ্জাম প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তাদের দাবি, এসব উপকরণ অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হতে পারে।