
ইতিহাসের পাতায় যেসব মহান আত্মা আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বালিয়েছেন মানবতার পথ, তাদের মধ্যে “মওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.” এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাত শতাব্দী পরেও যার বাণী আজ বিশ্বজুড়ে অনুরণিত হয় প্রেম, সহিষ্ণুতা ও ঐক্যের অমোঘ মন্ত্র হয়ে। সুফি দর্শনের এই মহান সাধক কেবল একজন কবি নন, তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লবী, যিনি ধর্ম-বর্ণ-জাতির সব কৃত্রিম দেয়াল ভেঙে মানবহৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ঐশ্বরিক প্রেমের মহিমা।
শহরের নামইতিহাস খুব কম মানুষকেই এমন মর্যাদা দেয় যেখানে তারা তাদের জন্মকালের গণ্ডি পেরিয়ে সমস্ত যুগের, সব সংস্কৃতির, সর্বকালের হয়ে ওঠেন। “মওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.)” তেমনই এক বিরল ব্যক্তিত্ব – যিনি ১৩শ শতাব্দীতে জন্ম নিয়েও ২১শ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগের মানুষের হৃদয়ে সমানভাবে ধ্বনিত হচ্ছেন। তিনি শুধু একজন কবি বা দার্শনিক নন, তিনি মানবাত্মার অনন্ত পথপ্রদর্শক।
সুফি দর্শনের মহান কবি, প্রেমের আখ্যানকারী ও আধ্যাত্মিক গুরু “মওলানা জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (রহ.)”-এর জীবন ও শিক্ষা আজও বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। তার জীবনযাপন, সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন।
মওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) ১২০৭ সালে (বর্তমান আফগানিস্তানের “বালখ” শহরে) জন্মগ্রহন করেন । তার বাবা “বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ” ছিলেন একজন প্রখ্যাত ধর্মীয় পণ্ডিত। মঙ্গোল আক্রমণের কারণে পরিবারটি “প্রথমে নিশাপুর”,পরে “কনিয়া” (তুরস্ক)-তে স্থায়ী হয়। ছোটবেলা থেকেই রুমি কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও দর্শনে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
“রুমি হচ্ছেন সেই বিরল প্রতিভা, যিনি কাব্য ও দর্শনের সীমারেখা মুছে দিয়েছেন,” বলেছেন প্রখ্যাত রুমি গবেষক ড. আনোয়ার আলী। তার প্রতিটি শব্দে মিশে আছে গভীর তাত্ত্বিক চিন্তা আর হৃদয়স্পর্শী আবেগের অনন্য সমন্বয়। রুমির বিশেষত্ব এই যে, তিনি জটিল আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে এমন সহজ-সরল গল্প ও উপমায় ব্যক্ত করেছেন যা একজন সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে একজন পণ্ডিত – সকলেরই হৃদয়ে প্রবেশ করে।
“তিনি এমন এক ভাষায় কথা বলেছেন, যা হৃদয়ের সব ভাষাকে বুঝতে পারে,” বলেছেন নোবেলজয়ী কবি টিএস এলিয়ট। রুমির কবিতা শুধু সাহিত্য নয়, এটি এক জীবন্ত প্রার্থনা, এক অনন্ত যাত্রা – ঈশ্বরের দিকে, আত্মার গভীরে, মানবতার মর্মমূলে। তার লেখনীতে মিলেছে ইসলামের সুফি ঐতিহ্য, পারস্যের কবিতার শিল্পসৌকর্য আর বিশ্বমানবের জন্য সার্বজনীন প্রেমের বার্তা।
“আমি খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু নই – আমি কেবল ঈশ্বরের প্রেমে মত্ত এক আত্মা,” এই ঘোষণার মাধ্যমে রুমি প্রতিষ্ঠা করেছেন আধ্যাত্মিকতার এক নতুন মাত্রা, যেখানে সব ধর্মের সার্বজনীন সত্য মিলেমিশে একাকার। আজ যখন পৃথিবী বিভেদের আগুনে জ্বলছে, রুমির বাণী হয়ে উঠেছে শান্তির সেতু, প্রেমের মশাল, মানবতার মিলনমন্ত্র।
১২৪৪ সালে রুমির জীবনে বড় পরিবর্তন আসে “দরবেশ শামস তাবরিজি”-এর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে। শামসের প্রভাবে রুমি গভীর প্রেম ও আধ্যাত্মিকতায় ডুবে যান। শামসের অকাল প্রস্থান (হত্যা বা রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান) রুমিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়, যা তাকে “দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ”(শামসের প্রতি উৎসর্গীকৃত কবিতা) রচনায় উদ্বুদ্ধ করে।
সাহিত্যকর্ম:
অমর সৃষ্টির ইতিহাস
রুমির রচনাগুলো “ফার্সি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ” হিসেবে বিবেচিত:
1. মসনবি-ই-মানবি (Mesnevi): ২৫,০০০ পংক্তির এই মহাকাব্য সুফি দর্শনের “কুরআন” নামে পরিচিত। এতে মানবতা, প্রেম ও ঈশ্বরানুসন্ধানের গল্প ও উপদেশ রয়েছে।
2. “দিওয়ান-ই-কবির”: শামসের নামে উৎসর্গীকৃত গজল ও কবিতার সংকলন।
3. “ফিহি মা ফিহি (In It What Is In It):” রুমির বক্তৃতা ও কথোপকথনের সংকলন।
কিছু বিখ্যাত উক্তি যা এখনও মানুষ প্রতিনিয়ত লালন করে,
– “তুমি সমুদ্রের এক ফোঁটা নও, বরং এক ফোঁটার মধ্যে সমগ্র সমুদ্র।”
– “কীভাবে বিষাদে ডুবে থাকো, যখন জীবন এত সুন্দর?”
– “গতকাল আমি জ্ঞানী ছিলাম, তাই পৃথিবী বদলাতে চেয়েছিলাম। আজ আমি বিচক্ষণ, তাই নিজেকে বদলাচ্ছি।”
“তিনি মানবজাতিকে শিখিয়েছেন কীভাবে হৃদয় দিয়ে দেখতে হয়,” বলেছেন নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রুমির দর্শন আমাদের শেখায় যে বাহ্যিক চোখে আমরা শুধু রূপ দেখি, কিন্তু হৃদয়ের চোখে দেখতে পাই সৌন্দর্য। বাহ্যিক কান দিয়ে আমরা শব্দ শুনি, কিন্তু হৃদয়ের কান দিয়ে শুনতে পাই সুর।
“রুমি হচ্ছেন মানব ইতিহাসের সেই সেতু, যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, ধর্ম ও বিজ্ঞান, হৃদয় ও বুদ্ধি একাকার হয়ে যায়,”বলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জেমস কাউন্ট। তার লেখনীতে ইসলামের সুফি ঐতিহ্য, গ্রিক দর্শনের যুক্তিবাদিতা, পারস্যের কাব্যিক সৌন্দর্য এবং ভারতীয় যোগ দর্শনের গভীরতা এক অনন্য সংমিশ্রণে মিলিত হয়েছে।
“তিনি শুধু কবিতা লেখেননি, তিনি লিখেছেন হৃদয়ের গভীরতম সত্য,” বলেছেন মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট। রুমির প্রতিটি কবিতা যেন এক একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে পাঠক নিজের অজান্তেই আবিষ্কার করে ফেলে নিজের অন্তর্নিহিত সত্যকে।
তার দর্শনের কেন্দ্রীয় বিষয়: প্রেমই হলো ঈশ্বরের পথ। রুমির শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো “প্রেম, সহিষ্ণুতা ও আত্মবিশ্লেষণ” :
– “সর্বজনীন প্রেম:” তিনি ঈশ্বরের প্রেমকে সব ধর্ম ও জাতির ঊর্ধ্বে স্থান দিতেন।
– “সাম্য ও মানবতা:” “মসজিদ, গির্জা বা মন্দির—সবই প্রেমের আলোয় এক।”
– “আত্মউপলব্ধি:” “নিজেকে জানার মধ্যেই স্রষ্টাকে জানা নিহিত।”
রুমির সৃষ্টি সমূহ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং অমর জনপ্রিয়তা লাভ করে।
“সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি” হিসেবে বিবিসি, ২০১৪ সালে তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তার কবিতা “ইংরেজি, বাংলা, স্প্যানিশসহ ৫০+ ভাষায়” অনূদিত।
“৩০ সেপ্টেম্বর” তার (মৃত্যুদিন) “রুমি দিবস” হিসেবে পালিত হয়। পশ্চিমা বিশ্বে তার দর্শন “মনোবিজ্ঞান ও আত্মউন্নয়নে” ব্যবহৃত হয়।
“রুমির বার্তা আজকের এই বিভক্ত বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন,” বলেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন। যখন পৃথিবী ধর্ম, বর্ণ, জাতিতে বিভক্ত, রুমি আমাদের শেখান যে ঈশ্বরের সন্ধান মসজিদ-মন্দির-গির্জায় নয়, বরং প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে।
“তিনি শুধু অতীতের সম্পদ নন, তিনি ভবিষ্যতের পাথেয়,” বলেছেন ডালাই লামা। রুমির শিক্ষা আমাদের শেখায় কিভাবে প্রযুক্তিনির্ভর এই যান্ত্রিক যুগেও আত্মার শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়, কিভাবে বস্তুবাদী সমাজেও আধ্যাত্মিকতার স্থান করে নেওয়া যায়।
তার জীবনকথা শুধু অতীতের ইতিহাস নয়, এটি বর্তমানের প্রেরণা ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশ। আসুন, ডুব দেই এই মহান আত্মার জীবন ও দর্শনের গভীরে…
১২৭৩ সালের “১৭ ডিসেম্বর” (ইসলামি মাসের “১৭ই জমাদিউস সানি”) কনিয়ায় রুমি ইন্তেকাল করেন। তার মাজার “মেভলানা জাদেগাহ” আজও লক্ষ্যভক্তের তীর্থস্থান।
মৃত্যুর আগে তার শেষ বাণী ছিলো- “মৃত্যুর পরে আমার কবরে এমন আলো জ্বালিও না, যা মানুষকে অন্ধকারে ফেলে… বরং এমন আলো দাও, যা হৃদয়কে জাগ্রত করে।”
আধুনিক যুগেও রুমি-কে কেউ ভুলে যায়নি বরং সেই দিনগুলোর মত সমানভাবে তাকে এবং তার অমর সৃষ্টিকে বুকে গেঁথে রেখেছে। তার উক্তি “গুগল, টেড টকস ও স্ব-উন্নয়ন বইয়ে” ব্যবহৃত হয়।
এমনকি মিউজিক ও শিল্পে প্রভাব মাদোনা, ডিপাক চোপড়া তার কবিতা উদ্ধৃত করেন।
রুমি শুধু কবি নন, তিনি “মানবতার দূত” তার জীবনী ও বাণী আজও মানুষকে শেখায় “প্রেম দিয়ে বিভেদ মুছে ফেলার”।