
ছবি : সংগ্রহীত
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নিলেও, চিকিৎসার অভাবে তাদের এক-তৃতীয়াংশই এক বছরের আগেই মারা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ শিশুর জীবনই রক্ষা করা সম্ভব। তবে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এখনো শিশু হৃদরোগ শনাক্ত ও চিকিৎসায় পর্যাপ্ত অবকাঠামো, জনবল এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই। এমনকি চিকিৎসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমে শিশু হৃদরোগকে অন্তর্ভুক্ত না করাকে বড় এক ঘাটতি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন, যিনি কারিকুলাম সংশোধনে এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর কল্যাণপুরে কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী জাতীয় বৈজ্ঞানিক সেমিনার ‘নিউনেটাল কার্ডিয়াক কনফারেন্স ২০২৫’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। তারা জানান, বর্তমানে দেশে নবজাতক হৃদরোগ শনাক্ত ও চিকিৎসায় যে পরিমাণ অবকাঠামো, আইসিইউ সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন, তা মোট চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশের মতো। অর্থাৎ শতকরা ৮৫ ভাগ নবজাতক হৃদরোগী এখনো কার্যকর চিকিৎসার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং সরকারি পর্যায়ে কোনো জাতীয় স্ক্রিনিং বা শনাক্তকরণ কর্মসূচি না থাকায় এ সংকট দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অভিমত
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, “চাইল্ড কার্ডিয়াক সেক্টরে আমরা যদি দক্ষ জনবল তৈরি করতে না পারি, তাহলে শুধু যন্ত্রপাতি দিয়েই কোনো লাভ হবে না। এখনো চিকিৎসা কারিকুলামে এ বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব নেই—যা আমাদের ব্যর্থতার বড় উদাহরণ।”
অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন আরও বলেন, “একজন শিশু যখন জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়, তখন সে মূলত প্রথমে সাধারণ পেডিয়েট্রিশিয়ান বা নিউনেটোলজিস্টের কাছে যায়। কিন্তু তারা অনেক সময় বোঝেন না, এই শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা এখনো তাদের (চিকিৎসকদের) এ বিষয়ে বিশেষায়িত কোনো প্রশিক্ষণ দিতে পারিনি, কারণ আমাদের কারিকুলামেই এটি নেই। কার্ডিয়াক সার্জারির বিষয়টাই নেই, পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি তো অনেক দূরের কথা।”
তবে আশার কথা হলো, এ সংকট কাটাতে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর আগামীতে কারিকুলাম রিভিউয়ের উদ্যোগ নিচ্ছে। ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, “আমাদের কারিকুলামের মিডটার্ম রিভিউ শুরু হচ্ছে। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এবার আমরা এ ঘাটতি পূরণে কাজ করব।” তিনি আরও বলেন, “আমরা অনেক সময় যন্ত্রপাতি কিনে ফেলি কিন্তু সেটি চালানোর মতো দক্ষ জনবল থাকে না। চাইল্ড কার্ডিয়াক চিকিৎসায় এটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। তাই আমরা এখনই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালুর পরিকল্পনা নিচ্ছি।”
আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থাকে দেশের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত করার বিষয়েও তারা আগ্রহী বলে জানান। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, বারডেম, শিশু হাসপাতাল—এমন প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালায়, তাহলে সংকট কিছুটা হলেও কাটবে বলেও তিনি পরামর্শ দেন।
ডিজি বলেন, “একটা পরিবারে যখন জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত একটি শিশুর জন্ম হয়, তখন সেই পরিবারের জন্য এটি শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে বিশাল এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যদি মানবিকভাবে এটাকে না দেখি, তাহলে সেটি অন্যায় হবে।” তার অভিজ্ঞতায়, দেশের পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জনরা সাধারণত বেশি মানবিক। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “তারা কেবল অর্থ নয়, দায়িত্ব ও সহানুভূতির জায়গা থেকে শিশুর চিকিৎসায় নিজেদের উজাড় করে দেন। কিন্তু আমরা যদি তাদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না দিই, তাহলে তারা একাই কতদূর যাবেন?”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশু হৃদরোগ সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের জন্য হৃদরোগ স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া চালু করা, যাতে জন্মের পরপরই ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের শনাক্ত করা যায়।
পাশাপাশি দেশের মেডিকেল শিক্ষার কারিকুলামে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি ও সার্জারির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেন তারা। এছাড়া চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এই কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দেন বক্তারা।
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মানবসম্পদের পাশাপাশি সরকারকে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসাকে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনার বিষয়েও ভাবতে হবে। কারণ, অধিকাংশ পরিবার এ চিকিৎসার ব্যয় বহনে অক্ষম হওয়ায় বহু শিশু জীবনরক্ষার সুযোগ না পেয়েই মৃত্যুবরণ করছে। সরকারি হাসপাতালে চাইল্ড কার্ডিয়াক ইউনিট স্থাপন এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে সহজলভ্য