
ছবি : সংগ্রহীত
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুদের মধ্যে হঠাৎ করে জ্বরের প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগই প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে, পরবর্তীতে বমি যোগ হচ্ছে এবং অনেকে কিছুই খেতে না পেরে দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা, মুখের ভেতরে ঘা, গলাব্যথা ও চোখ লাল হওয়ার মতো অতিরিক্ত উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি অভিভাবকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এটি সাধারণ ভাইরাল জ্বর হতে পারে, তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা এন্টারোভাইরাসের সংক্রমণও এর পেছনে থাকতে পারে। সতর্কতার অংশ হিসেবে আক্রান্ত শিশুদের সিবিসি, ডেঙ্গু, টনসিল এবং থ্রোট ইনফেকশনের বিভিন্ন পরীক্ষা করানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশনের কারণে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে।
সোমবার (২৩ জুন) রাজধানীর ডিএনসিসি হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি জ্বর আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিতে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় ভাইরাসজনিত সংক্রমণ বাড়ে, তবে এবার অনেক শিশুর উপসর্গ হঠাৎ শুরু হচ্ছে এবং তারা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেরিতে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ায় বেশিরভাগ শিশুর অবস্থা জটিল হচ্ছে।
বরগুনা থেকে ঢাকায় আসা ১১ বছর বয়সী শিশু মারুফের ঘটনা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হালকা জ্বর দেখে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ানোর পর জ্বর না কমায় তাকে বরগুনা জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ততক্ষণে তার শরীর অনেক দুর্বল হয়ে পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায়। মারুফের বাবা খাইরুল ইসলাম জানান, বরগুনায় অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বরিশালে, এবং সেখান থেকে অবশেষে ঢাকায় ডিএনসিসি কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেরিতে হাসপাতালে নেওয়ার কারণে তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখা গেছে, অর্ধেক রোগীই জ্বর নিয়ে আসা শিশু। উত্তরা থেকে ছয় বছরের তাওহীদকে নিয়ে আসা মা সুমাইয়া খাতুন জানান, তার ছেলের হঠাৎ জ্বর আসে এবং বমি শুরু হয়। স্থানীয় ফার্মেসির ওষুধে কাজ না হওয়ায় তিনি ভয়ে ঢাকায় এসেছেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ৮ বছর বয়সী মারিয়া ইসলামও গলাব্যথা ও মুখের ভেতরে লাল দাগ নিয়ে এসেছে, যা তাকে খেতে বাধা দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের নতুন উপধরনের উপস্থিতির পাশাপাশি ডেঙ্গু, ভাইরাল ফ্লু, হ্যান্ড-ফুট-মাউথ ডিজিজ, ডায়রিয়া এবং রোটা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ একসঙ্গে সক্রিয় রয়েছে। উপসর্গগুলোর মধ্যে মিল থাকায় মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং একই সঙ্গে জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পাতলা পায়খানা বা খাওয়ার অক্ষমতার মতো উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। এই জটিল পরিস্থিতিতে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে সংক্রমণের হার এবং জটিলতা তুলনামূলকভাবে বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, “দেশে একসঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। উপসর্গের মিল থাকায় অনেকে বুঝে উঠতে পারেন না কোনটি আসলে কী? এতে তারা অকারণে ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। অনেকে চিকিৎসা নিতে দেরি করেন বা ভুল ওষুধ খেয়ে জটিলতা বাড়ান।” তিনি আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন এবং জ্বর, বমি বা পাতলা পায়খানার মতো উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে স্থানীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বলেছেন। সময়মতো ডেঙ্গু ও করোনার টেস্ট করানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. এবিএম মাহফুজ হাসান আল মামুন জানান, ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা বাড়ছে এবং ভাইরাল জ্বরও বেড়ে যাচ্ছে। তিনি তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, চোখ লাল হওয়া বা শরীরে লালচে দাগের মতো উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে শুরুতে প্যারাসিটামল সিরাপ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি অভিভাবকদের শিশুদের প্রচুর পানি ও তরলজাতীয় খাবার, পাশাপাশি ডিম ও মুরগির মাংসের মতো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে বলেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, এই সময়ে ভাইরাল সংক্রমণ বাড়লেও এবার ডেঙ্গুর সঙ্গে মিশ্র ভাইরাল ইনফেকশন এবং কিছু ক্ষেত্রে হালকা করোনাভাইরাস সংক্রমণ একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যা চিকিৎসা ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে বলেছেন এবং ঘরে বসে চিকিৎসা না নিয়ে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরের হাসপাতালগুলোতে সেবা প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং বরগুনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, পটুয়াখালীর মতো জেলাগুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। বরগুনায় মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় মেডিসিন ও স্যালাইন সরবরাহ করা হয়েছে।