চিকুনগুনিয়া: কারা বেশি ঝুঁকিতে, চিকিৎসা পদ্ধতি ও প্রতিরোধের উপায়

নিজেস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

চিকুনগুনিয়া (Chikungunya) একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সাধারণত হঠাৎ জ্বর, তীব্র জয়েন্ট ব্যথা, ত্বকে র‍্যাশ, মাথাব্যথা এবং দুর্বলতার মতো লক্ষণ সৃষ্টি করে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় এই রোগটি জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০০-এর দশকে ইউরোপ ও আমেরিকাতে প্রথম ছড়িয়ে পড়ার পর, ২০১৪ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল।

 

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) Togaviridae পরিবারের অন্তর্গত এবং Alphavirus গণের সদস্য। রোগটি মূলত Aedes aegypti এবং Aedes albopictus প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়, যারা সাধারণত দিনের বেলায় বেশি সক্রিয় থাকে। এই রোগের উপসর্গকে অনেক সময় ডেঙ্গু জ্বর এবং জিকা ভাইরাস জ্বরের সাথে ভুল করে তুলনা করা হয়, কারণ একই মশার কামড়ে এই তিন ভাইরাস সংক্রমণ হয় এবং রোগের লক্ষণেও অনেক মিল দেখা যায়। তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে তারা ভিন্ন ভিন্ন জটিলতা তৈরি করে।
‘Chikungunya’ শব্দটি এসেছে তানজানিয়ার মাকুন্দি জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত কিমাকোন্ডি ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘বাঁকা হয়ে যাওয়া’—কারণ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা জয়েন্ট ব্যথার কারণে হাঁটার সময় শরীর বাঁকা করে ফেলে। এই ভাইরাস সাধারণত হঠাৎ জ্বর, তীব্র জয়েন্ট ব্যথা, ত্বকে র‍্যাশ, মাথাব্যথা এবং দুর্বলতার মতো রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করে।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৫২ সালে তানজানিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। এরপর এটি আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৪ সাল থেকে এই রোগটি আরও বিস্তৃতভাবে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়াতে শুরু করে।

 

বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া প্রথম শনাক্ত হয় ২০০৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়, তবে তখন এটি সীমিত আকারে ছিল। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এটি লক্ষ্য করা গেলেও এরপর তেমনভাবে এই ভাইরাসের কথা শোনা যায়নি। তবে ২০১৭ সালের প্রথমদিকে সারাদেশে ভাইরাসটি উল্লেখযোগ্য হারে লক্ষ্য করা যায়। তখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়। ওই সময়ে জুন থেকে আগস্ট মাসে এই ভাইরাস সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকায় ২০১৭ সালের জুলাই মাসেই প্রায় ১৩,০০০ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।

 

Aedes মশাগুলো সাধারণত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়, যেমন ফুলের টব, ভাঙা পাত্র, পানির ট্যাংক, ড্রাম ইত্যাদি। সাধারণত আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশা চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি তার শরীরে গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে অন্য ব্যক্তিদের কামড়ানোর মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। ভাইরাসবাহী মশার কামড়ে ভাইরাস রক্তে প্রবেশ করলে ৩-৭ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়।

চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ সাধারণত হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং তা বেশ তীব্র হতে পারে। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
* হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর (১০২°F বা তার বেশি)
* তীব্র জয়েন্ট ব্যথা (বিশেষ করে হাতে, পায়ে, গোড়ালি, কাঁধ, হাঁটুতে এবং কব্জিতে)
* ত্বকে র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি
* মাথাব্যথা
* পেশি ব্যথা
* ক্লান্তি ও দুর্বলতা
* চোখে ব্যথা বা লালচে ভাব
জয়েন্ট ব্যথা কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
চিকুনগুনিয়ায় সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারে। তবে কিছু জনগোষ্ঠী বেশি ঝুঁকিতে থাকে:
* বয়স্ক ব্যক্তিরা (৫০ বছরের বেশি): এদের জয়েন্ট ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
* গর্ভবতী নারী: গর্ভের শিশুর শরীরেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
* দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগা রোগী (যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, কিডনি রোগ, লিভার রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি): এদের মধ্যে জটিলতা বেশি দেখা দিতে পারে।
* শিশুরা: এদের মধ্যে উপসর্গ তুলনামূলকভাবে হালকা হতে পারে। তবে নবজাতক বা ১ বছরের নিচে শিশুদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিতে পারে এবং হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতে পারে। অনেক সময় শিশুদের ক্ষেত্রে খিঁচুনি, ত্বকে ফুসকুড়ি, প্রচণ্ড মাথাব্যথা অথবা কিডনি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

এই রোগ সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করে ভাইরাসের আরএনএ বা ভাইরাসের এন্টিবডির মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।

চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই।

চিকিৎসা মূলত উপসর্গ নির্ভর (Symptomatic Treatment)।
* জ্বর ও ব্যথার জন্য: প্যারাসিটামল (Paracetamol) দেওয়া হয়।
* জয়েন্ট ব্যথা কমাতে: হালকা ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম দরকার।

* পানি ও তরল: প্রচুর পানি এবং পানি জাতীয় তরল (ডাবের পানি, শরবত, ঘরে তৈরি ফলের জুস) পান করতে হবে ডিহাইড্রেশন রোধের জন্য।
* অন্যান্য ওষুধ: স্টেরয়েড ও নন-স্টেরয়েডাল এন্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ (NSAIDs) কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা উচিত নয়, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, কারণ এটি ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

 

সাধারণত জ্বর কমানোর জন্য ওষুধ, ব্যথা উপশম করার জন্য ওষুধ, প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা এবং পরিমিত বিশ্রাম নিলে ৫-১০ দিনে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যান। কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোনো রোগ-উপসর্গ প্রকাশ পায় না। তবে তীব্র রোগের লক্ষণ এবং গুরুতর কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।

 

চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ ও মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া:

* কোথাও জমে থাকা পানি অপসারণ করা।
* ফুলের টব, টায়ার, ড্রাম পরিষ্কার রাখা।
* দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা।
* জানালা ও দরজায় জালি লাগানো।
* প্রয়োজনে মশা নিরোধক স্প্রে ব্যবহার, মশা প্রতিরোধী ক্রিম বা রিপেলেন্ট ব্যবহার করা।
* ফুলহাতা জামা-কাপড় পরা।
* অফিসেও সতর্ক থাকা এবং শিশুদের মশার কামড় থেকে রক্ষা করতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা।

 

বাড়ির চারপাশে পানি জমতে না দেওয়া এবং যেখানে সেখানে মশা ডিম পাড়তে না পারে সে খেয়ালও রাখতে হবে। মশার প্রজনন স্থানে মশা ধ্বংস করার ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যক্তি এবং সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের কোনো টিকা নেই। তবে বিভিন্ন দেশে গবেষকরা টিকা নিয়ে কাজ করছেন।

বাংলাদেশে জুন ২০২৫-এ চিকুনগুনিয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০ জুন পর্যন্ত ঢাকায় ১ জানুয়ারি – ২৮ মে পর্যন্ত আইইডিসিআর-এ ৩৩৭ নমুনার মধ্যে ১৫৩ জন শনাক্ত হয়েছে। ১ – ২১ জুন আইসিডিডিআর,বি’র কেন্দ্রে ১৭১ নমুনার মধ্যে ১৪০ জন শনাক্ত হয়েছে।

 

সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী ঢাকায় জ্বর বা অন্যান্য উপসর্গ আছে এমন রোগীদের মধ্যে এই ভাইরাস শনাক্ত হার এখনও উঁচু। সরকারি পর্যায়ে কোভিড ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেক প্রস্তুতি নেওয়া হলেও চিকুনগুনিয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি তেমন সক্রিয় নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষার শেষ দিকে মশা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা একাধিক রোগের “ত্রিমুখী চাপ” সৃষ্টি করতে পারে।

 

ঢাকা প্রধান প্রাদুর্ভাব কেন্দ্র হলেও অন্যান্য শহরেও জ্বর পরিস্থিতি এবং শনাক্ত হার এমন পর্যায়ে আছে যা প্রাথমিকভাবে নজরে আনা প্রয়োজন। ডেঙ্গু ও করোনার মধ্যে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ত্রিমুখী সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ফলে এখন থেকেই মশা নিধনের ব্যাপারে সচেতন হওয়া খুব জরুরি, কারণ এই একটা মশা দিয়েই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ ছড়ায়।

 

চিকুনগুনিয়া যদিও সে অর্থে প্রাণঘাতী নয়, তবে রোগটি নিত্যদিনের সাধারণ জীবনযাত্রায় অনেক বড় প্রভাব ফেলে। বর্ষা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এই রোগটির প্রাদুর্ভাব আবার দেখা দিয়েছে। তাই এখনই সব পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনসচেতনতা, মশা নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হলো এই রোগ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।

সম্পর্কিত খবর

এই পাতার আরও খবর

সর্বশেষ