
জেদ্দা, সৌদি আরব: সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিআইএসজে) দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সময়ে স্বজনপ্রীতি, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ এবং অস্বচ্ছতা বিদ্যালয়টির প্রশাসনিক কাঠামোয় গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে বলে মনে করছেন অভিভাবকরা।
অভিযোগ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেদ্দা কনস্যুলেটের কতিপয় কর্মকর্তা ও প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা গেছে। ২০১০ সাল থেকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীরা বিদ্যালয়ের পরিচালনায় একক আধিপত্য বিস্তার করেছে, যেখানে রাজনৈতিক পরিচয় নেতৃত্ব নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
আসন্ন ২০২৫ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে, বিদ্যালয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল এবং তার সমর্থকরা আবারও একই ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। অভিযোগ উঠেছে, জেদ্দা কনস্যুলেটের সিজি মঈনুল কবির, এমদাদ এবং আরিফুজ্জামান এই প্রক্রিয়ায় নেপথ্যে মদদ যোগাচ্ছেন।
বর্তমান চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল, যিনি ২০২১ সালে বিতর্কিত নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার মেয়াদে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে দলীয়করণ আরও প্রকট হয়েছে বলে অভিযোগ।
এক দশকেরও বেশি সময়ের অনিয়ম:
অভিভাবকদের অভিযোগ, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিআইএসজে-তে শিক্ষক ও প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের আত্মীয়-স্বজনদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। এমনকি, অধ্যক্ষ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক শিক্ষককে রাজনৈতিক আনুগত্য না থাকার অভিযোগে চাকরি হারাতে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের একটি অংশ এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব হলেও, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে।
নির্বাচনী কারসাজির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার ইতিহাস:
অভিযোগ রয়েছে, ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগপন্থী নেতারা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নির্বাচনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেছেন। ২০২১ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আতাউর রহমান মুকুল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, তিনি প্রশাসনিক কারসাজির মাধ্যমে নিজের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে নেন। ২০২৫ সালেও একই ধরনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়। এই পুরো সময়কালে, আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে প্রভাব খাটানো হয়েছে। এমনকি, নিরপেক্ষ প্রার্থীদের NSI তদন্তের নামে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। এর ফলে, দলীয় আনুগত্যহীন অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের পরিচালনায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
স্কুল প্রশাসনে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পরিষদ’ ও মুকুলের রাজনৈতিক প্রভাব:
চেয়ারম্যান হওয়ার পর আতাউর রহমান মুকুল ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পরিষদ’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করে জেদ্দায় প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আরও দৃঢ় করেন। অভিযোগ উঠেছে, তিনি স্কুল প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এই সংগঠনের ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তার সংগঠনের প্রভাব স্পষ্ট বলে মনে করেন অভিভাবকরা। বিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যেখানে শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিবর্তে ক্ষমতার অপব্যবহার মুখ্য ছিল।
২০২৫ সালের নির্বাচন ও অভিভাবকদের দাবি:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সাথে সাথে, জেদ্দার অভিভাবকরা এবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো:
* আতাউর রহমান মুকুল ও তার রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গোষ্ঠীকে বিদ্যালয় পরিচালনার বাইরে রাখতে হবে।
* নতুন পরিচালনা কমিটির নির্বাচন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং অভিভাবকদের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে।
* বিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
* গত ১৩ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
* বিদ্যালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা করে অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
অভিভাবকদের এই ঐক্যবদ্ধ দাবি বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ প্রশাসনের জন্য একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে—স্কুল প্রশাসন কি এবার সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে? নাকি পূর্বের মতোই অনিয়ম অব্যাহত থাকবে?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব মুক্ত করা সময়ের দাবি:
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, জেদ্দা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নয়, এটি প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় অভিভাবকদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—স্কুল প্রশাসন কি সত্যিই এবার একটি স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে? অভিভাবকরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কি মুকুলের রাজনৈতিক প্রভাব শেষ হবে? বিগত ১৩ বছরে বিদ্যালয়ে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তার কি কোনো বিচার হবে? আদৌ কি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফ্যাসিবাদ মুক্ত হতে পারবে? এখন এটাই দেখার বিষয়।