নগদে ডিজিটাল জালিয়াতি , লোপাট ২৩৫৬কোটি টাকা

নিজেস্ব প্রতিবেদক

নগদে ২,৩৫৬ কোটি টাকার ডিজিটাল জালিয়াতি, তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য

 

দেশের অন্যতম মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এ ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার ডিজিটাল জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকের তদন্তে উঠে আসে এই অনিয়মের বিস্তৃত চিত্র, যা দেশের আর্থিক খাতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, নগদ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন ছাড়াই ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক মানি (ই-মানি) ইস্যু করেছে। প্রকৃত অর্থ জমা ছাড়াই এই ই-মানি তৈরি করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম লঙ্ঘন।

 

তদন্তে আরও জানা যায়, ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রেরিত ভাতা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অনুমোদনহীন ৪১টি পরিবেশক এবং প্রায় ২৪ হাজার ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে ১,৭১১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

 

এ ঘটনার সঙ্গে নগদের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মিশুকসহ মোট ২৪ জনের নাম উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ৯ জন ডাক বিভাগের কর্মকর্তাও রয়েছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেছে।

 

নগদের ছয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথকভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন নগদের নির্বাহী পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা, আর্থিক প্রশাসন ও পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান এবং সলিউশন ডিজাইন বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট।

 

এদিকে নগদে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার বলেন, “এই অনিয়ম জাতীয় স্বার্থবিরোধী। ইতোমধ্যে ফরেনসিক নিরীক্ষা শুরু হয়েছে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনানুগ পদক্ষেপ চলছে।”

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মোবাইল ফিনান্সিয়াল খাতে এটি একটি নজিরবিহীন প্রতারণার ঘটনা। এতে গ্রাহকদের আস্থায় চরম ধাক্কা লেগেছে।

 

নগদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গ্রাহকের টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং বর্তমান প্রশাসন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রেখে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কাজ করছে।

 

নগদের প্রশাসক দল মনে করে যে অনুমোদন ছাড়াই যেসব পরিবেশক নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের ব্যবহার করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা ডাক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন নগদের নির্বাহী পরিচালক সাফায়েত আলম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা আবু রায়হান, আর্থিক প্রশাসন ও পরিচালনা বিভাগের প্রধান রাকিবুল ইসলাম এবং সলিউশন ডিজাইন বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুস সাকিব আকিব।

 

এ বিষয়ে নগদের প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার ৫ ডিসেম্বর ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও চুক্তিবদ্ধ পক্ষ হিসেবে ডাক বিভাগ এসব অনিয়ম/চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন/ক্ষতিপূরণের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে বলে প্রশাসক দল মনে করে। প্রশাসকের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।

 

গত ৫ আগস্টের পর আর অফিসে যাননি তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ; নির্বাহী পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ ওরফে এলিট ও মারুফুল ইসলাম ওরফে ঝলক; উপপ্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ সোলায়মান (সোলায়মান সুখন) এবং মানবসম্পদ কর্মকর্তা অনিক বড়ুয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২১ আগস্ট নগদে প্রশাসক বসায়। তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত ব্যক্তিদের অনেকে নগদ লিমিটেডের মালিকানায়ও রয়েছেন।

 

যোগাযোগ করা হলে নগদের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমার সময়ে ৩৪৫ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। এটা পরে কমে ৬০ কোটি টাকায় এসেছিল৷ অন্য কোনো অনিয়ম আমার সময়ে হয়নি।’

 

নগদের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি হয়েছে একটি ব্যাংকঋণ সমন্বয় করার কারণে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে কিস্তিতে সমন্বয় করা হচ্ছিল। প্রশাসক দায়িত্ব নিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছু ই-মানি ইস্যু হয়েছে পরিচালন খরচ মেটাতে গিয়ে। তিনি বলেন, ‘নগদের কার্যক্রম একরকম থমকে গেছে। নতুন করে কোনো অফার দেওয়া হচ্ছে না, প্রচারণাও প্রায় বন্ধ। ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রশাসক শুধু আগের ভুল ধরে চলছে।’

সম্পর্কিত খবর

এই পাতার আরও খবর

সর্বশেষ