মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা সম্প্রতি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী চাঁদ এবং সৌরজগতের অন্যতম বৃহৎ গ্রহাণু ভেস্টার অভ্যন্তরের গঠন নিয়ে এক অভূতপূর্ব গবেষণা পরিচালনা করেছে। এই অনুসন্ধানের ফলাফল জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গ্রহ বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে, কারণ এটি এই দুটি মহাজাগতিক বস্তুর অভ্যন্তরীণ কাঠামো সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছে এবং সৌরজগতের প্রারম্ভিক ইতিহাস সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
নাসার বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক মহাকাশযান থেকে সংগৃহীত ডেটা, যেমন অ্যাপোলো মিশনের সিসমিক ডেটা এবং চন্দ্র পুনরুদ্ধার অরবিটারের মাধ্যাকর্ষণ মানচিত্র, সেইসাথে ডন মহাকাশযানের ভেস্টার পৃষ্ঠের চিত্র এবং বর্ণালী বিশ্লেষণ করে এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, চাঁদ এবং ভেস্টার অভ্যন্তর মোটেও একঘেয়ে বা সরল নয়; বরং তারা জটিল স্তরবিন্যাস এবং অপ্রত্যাশিত উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, যা তাদের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং বিবর্তনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বহু দশক ধরে, বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে চাঁদের অভ্যন্তর একটি শীতল এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে নিষ্ক্রিয় স্থান। কিন্তু নাসার নতুন গবেষণা এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা চাঁদের ভূত্বকের ঠিক নীচে একটি আংশিক গলিত স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। এই আবিষ্কারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি চাঁদের অভ্যন্তরে এখনও কিছু পরিমাণে তাপীয় কার্যকলাপের ইঙ্গিত দেয় এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে পরিলক্ষিত টেকটোনিক বৈশিষ্ট্য এবং ভূমিকম্পের ব্যাখ্যা দিতে পারে।
শুধু তাই নয়, চাঁদের কেন্দ্র বা কোর সম্পর্কেও নতুন এবং চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। পূর্বের মডেলগুলোতে চাঁদের কোরকে একটি কঠিন লোহার গোলক হিসেবে ধারণা করা হতো। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, চাঁদের একটি কঠিন অভ্যন্তরীণ কোর রয়েছে, যা একটি তরল বহিঃস্থ কোর দ্বারা বেষ্টিত। এই আবিষ্কার চাঁদের দুর্বল হলেও বিদ্যমান চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি এবং বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে সহায়ক হতে পারে, যা একসময় শক্তিশালী ছিল বলে মনে করা হয়।
অন্যদিকে, গ্রহাণু ভেস্টা, যা মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝে অবস্থিত গ্রহাণু বেল্টের অন্যতম বৃহত্তম সদস্য, তার অভ্যন্তরীণ জটিল গঠন বিজ্ঞানীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। ডন মহাকাশযান দ্বারা প্রেরিত বিস্তারিত চিত্র এবং বর্ণালী ডেটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ভেস্টার একটি সুস্পষ্ট স্তরযুক্ত কাঠামো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল লোহার কোর, একটি ঘন পাথুরে গুরুমন্ডল এবং একটি আগ্নেয় ব্যাসাল্টিক ভূত্বক, যা ইঙ্গিত দেয় ভেস্টা একসময় ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় ছিল।
গবেষণায় ভেস্টার অভ্যন্তরে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের অপ্রত্যাশিত বণ্টনও লক্ষ্য করা গেছে। এই অস্বাভাবিক বণ্টন ভেস্টার তাপীয় ইতিহাস এবং দীর্ঘ বিবর্তনের ফলস্বরূপ বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। এছাড়াও, ভেস্টার পৃষ্ঠে অসংখ্য বিশাল আকারের প্রভাব খাদ (impact craters) তার অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে মূল্যবান সূত্র সরবরাহ করেছে। এই খাদগুলো গ্রহাণুটির অভ্যন্তরের গভীর স্তর পর্যন্ত উন্মোচিত করেছে, যা বিজ্ঞানীদের সরাসরি তার উপাদান এবং গঠন পরীক্ষা করার সুযোগ করে দিয়েছে।
নাসার এই যুগান্তকারী গবেষণাগুলি কেবল আমাদের নিকটতম মহাজাগতিক প্রতিবেশী এবং একটি বৃহৎ গ্রহাণুর অভ্যন্তরীণ জগৎ সম্পর্কে নতুন জ্ঞান সরবরাহ করেনি, বরং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ এবং গ্রহাণুদের উৎপত্তি ও বিবর্তনের রহস্য উন্মোচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই আবিষ্কারগুলি ভবিষ্যতে গভীর মহাকাশ অনুসন্ধানের পরিকল্পনা এবং কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে এবং আমাদের মহাজাগতিক পরিবেশ সম্পর্কে আরও গভীর এবং পূর্ণাঙ্গ ধারণা গঠনে সাহায্য করবে।