ছবি : সংগ্রহীত
ঈদুল আযহা, যা "কুরবানির ঈদ" নামে পরিচিত, ইসলামিক বর্ষপঞ্জির জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয়। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় উৎসব। এই দিনটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে পালন করা হয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ঈদুল আযহার বিস্তারিত বিধান ও তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে।
ঈদুল আযহার মূল ভিত্তি হলো হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগের ঘটনা। আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানি হয়। এই ঘটনাকে স্মরণ করে মুসলিমরা প্রতি বছর কুরবানি প্রদান করে।
কোরআনে উল্লেখ আছে,
"অতঃপর যখন সে (ইসমাইল) তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছাল, তখন ইব্রাহিম বললেন, ‘হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এখন তোমার মতামত কী?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’"
(সুরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০২-১০৩)
ঈদুল আযহার তাৎপর্যের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করে-
১. আল্লাহর প্রতি আনুগত্য: ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার শিক্ষা।
২. আত্মশুদ্ধি: কুরবানির মাধ্যমে সম্পদের মোহ ত্যাগ করে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়।
৩. সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব: গরিব-ধনীর মধ্যে মাংস বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা হয়। ধনী গরিবের মাঝে বিভেদ থাকে না। অসহায়েরা তাদের হক পায়।
ইসলামে কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। প্রথমত, ব্যক্তিকে মুসলিম ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাকে সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে। তৃতীয়ত, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। নিসাব হলো সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য কিংবা এর সমপরিমাণ সম্পদ (নগদ টাকা, ব্যবসার পণ্য, বা অপ্রয়োজনীয় জমি) থাকা। যদি কোনো ব্যক্তির কাছে এ পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং তা ঋণমুক্ত হয়, তাহলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। তবে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বা যার প্রয়োজনীয় সম্পদ ছাড়া অতিরিক্ত সম্পদ নেই, তার উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। এছাড়া, কুরবানির দিনগুলোতে (১০-১২ জিলহজ) ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক। যদি কেউ বছরের বেশিরভাগ সময় গরিব থাকে কিন্তু শুধু কুরবানির দিনগুলোতে সামর্থ্যবান হয়, তাহলেও তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।
হজ্জ পালনকারীদের জন্য কুরবানির বিশেষ বিধান রয়েছে। হজ্জের ধরন অনুযায়ী কুরবানি দেওয়া আবশ্যক বা ঐচ্ছিক হতে পারে। যেমন, "কিরান হজ্জ" বা "তামাত্তু হজ্জ" পালনকারীদের জন্য কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
"যে ব্যক্তি তামাত্তু বা কিরান হজ্জ আদায় করে, তার জন্য কুরবানি করা আবশ্যক।" (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ১৯৬)
এই কুরবানি মিনায় করা হয় এবং হাজী সাহেব নিজে বা তার পক্ষ থেকে কাউকে দিয়ে পশু জবেহ করেন। তবে "ইফরাদ হজ্জ" (শুধু হজ্জের নিয়ত করা) পালনকারীদের জন্য কুরবানি ওয়াজিব নয়, তবে নফল হিসেবে দেওয়া যায়।
হজ্জের সময় কুরবানি দেওয়ার পর হাজীরা মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করেন, যা ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়ার অন্যতম রুকন। এরপর তারা তাওয়াফে জিয়ারত ও সাঈ সম্পন্ন করে হজ্জের মূল কাজ শেষ করেন। মক্কায় কুরবানি দেওয়ার পশুর গোশত সেখানকার গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যা হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দিক।
এই বিধানগুলো কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এবং সঠিকভাবে পালন করলে হজ্জ ও কুরবানি উভয়ই আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে।
হাদিসে আছে-
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, "কুরবানির দিনে আদম সন্তানের কোনো আমলই আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত করার (কুরবানি করার) চেয়ে প্রিয় নয়। কুরবানিকৃত পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। অতএব, তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি করো।"
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৬)
ঈদুল আযহায় করণীয় কাজসমূহ
১. ঈদের নামাজ: জিলহজের ১০ তারিখ সকালে ঈদগাহে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করা।
২. কুরবানি দেওয়া: সামর্থ্যবান মুসলিমদের জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। (সুরা আল-কাউসার, আয়াত ২)
৩. তাকবিরে তাশরিক: ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবির বলা।
"আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।"
৪. গোশত বণ্টন: কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে ও এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য রাখা।
ইসলামিক বিধি-বিধান
১. কুরবানির শর্ত:
- প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া।
- পশু নির্দিষ্ট বয়সের (উট: ৫ বছর, গরু: ২ বছর, ছাগল/ভেড়া: ১ বছর) হতে হবে।
- পশু নিখুঁত ও রোগমুক্ত হতে হবে।
২. সময়: নামাজের পর ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানি করা যায়।
৩. নিষিদ্ধ কাজ:
- কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করা হারাম। এটি দান করতে হবে।
- রাসুল (স.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করল, তার কুরবানি হয়নি।"(বাইহাকি)
ঈদুল আযহা মুসলিমদের জন্য ত্যাগ, আনুগত্য ও সামাজিক সম্প্রীতির মহান শিক্ষা বহন করে। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে এর বিধানগুলো মেনে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। এই দিনে গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়ানো এবং আল্লাহর জিকিরে মশগুল হওয়াই হলো ঈদের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
সূত্র:
১. পবিত্র কোরআন
২. সহিহ বুখারি ও মুসলিম
৩. সুনানে আবু দাউদ