
ছবি : সংগৃহীত
বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র একজনের দেহে এই বিরল রক্তের গ্রুপ শনাক্ত হয়েছে। এই অভূতপূর্ব আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞান, জিনতত্ত্ব এবং মানব বিবর্তনের ধারণাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। কিন্তু এই রক্তের গ্রুপে এমন কী বিশেষত্ব আছে?
রক্তের গ্রুপ মূলত নির্ধারিত হয় লোহিত রক্তকণিকার গায়ে থাকা বিশেষ প্রোটিন বা অ্যান্টিজেনের উপর ভিত্তি করে। সহজ ভাষায়, কোনো ব্যক্তির রক্তে যদি ‘A অ্যান্টিজেন’ থাকে, তবে তার রক্তের গ্রুপ ‘A’; ‘B অ্যান্টিজেন’ থাকলে ‘B’; উভয় থাকলে ‘AB’; আর কোনোটিই না থাকলে ‘O’গ্রুপ ধরা হয়। এছাড়াও, ‘Rh ফ্যাক্টর’ নামক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন রয়েছে। Rh থাকলে রক্তের গ্রুপ ‘পজিটিভ (+)’এবং না থাকলে ‘নেগেটিভ (-)’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এভাবে ‘A+, B-, O+’, ইত্যাদি পরিচিত গ্রুপগুলো গঠিত হয়।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা একটি সম্পূর্ণ নতুন রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করেছেন, যা এর আগে কখনও চিহ্নিত হয়নি। লাইফ সায়েন্স, পপুলার মেকানিক্স এবং সায়েন্স অ্যালার্ট-এর মতো বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই গ্রুপের নাম দেওয়া হয়েছে “গোয়াডা নেগেটিভ” (Gwada Negative)। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একে ‘G নেগেটিভ’ বলেও ডাকা হচ্ছে।
এই রক্তের গ্রুপের নামকরণের পেছনে একটি ভৌগোলিক ইতিহাস জড়িত। ফ্রান্সের এক মহিলার দেহে এই গ্রুপ পাওয়া গেছে, যিনি ক্যারিবীয় অঞ্চলের “গোয়াডেলুপ দ্বীপ”এর বাসিন্দা। স্থানীয় ভাষায় এই দ্বীপকে “গোয়াডা”বলা হয়, এবং সেখান থেকেই এই রক্তের গ্রুপের নামকরণ করা হয়েছে।
যখন এই মহিলা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন, তখন রুটিন রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় যে তার রক্ত প্রচলিত কোনো গ্রুপের সাথেই মেলে না। এমনকি আগে শনাক্ত করা বিরল উপ-গ্রুপগুলোর সাথেও তার রক্তের মিল নেই। পরে বিশেষায়িত ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার রক্তকণিকায় RHT এবং HRS নামক দুটি অ্যান্টিজেনের সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য তাকে বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তিতে পরিণত করেছে—যার রক্ত শুধুমাত্র তার নিজের শরীরেই কাজ করবে, অন্য কারো সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ‘জিনগত মিউটেশন’ বা রূপান্তরের ফল। তার পূর্বপুরুষদের কারো জিনে বিরল পরিবর্তনের কারণে এই রক্তের ধরণ তৈরি হয়েছে। ইকোনমিক টাইমস-এর একটি রিপোর্টে এটিকে “আল্ট্রা-রের ব্লাড গ্রুপ”হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ধরনের রক্তের গ্রুপের ব্যক্তির জন্য রক্তদান বা গ্রহণ অত্যন্ত জটিল। যদি তার কোনো দিন রক্তের প্রয়োজন হয়, তবে মিলবে না বললেই চলে। তাই তার রক্ত সংরক্ষণ করে রাখাই একমাত্র সমাধান। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে রক্তের গ্রুপ জানা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
যদি কোনো ব্যক্তির রক্তে কোনো অ্যান্টিজেন না থাকে, কিন্তু তাকে এমন রক্ত দেওয়া হয় যেখানে অ্যান্টিজেন রয়েছে, তাহলে তার ইমিউন সিস্টেম সেই রক্তকে আক্রমণ করবে। এই অবস্থাকে ‘হেমোলাইটিক ট্রান্সফিউশন রিঅ্যাকশন’বলা হয়, যা জ্বর, শ্বাসকষ্ট, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। তাই হাসপাতালগুলোতে রক্ত সঞ্চালনের আগে কঠোরভাবে ‘ক্রস-ম্যাচিং’ পরীক্ষা করা হয়।
এই আবিষ্কার শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানেই নয়, জিনতত্ত্ব এবং মানব বিবর্তনের গবেষণায়ও নতুন দিক খুলে দিয়েছে। রক্তের অ্যান্টিজেনের এই বৈচিত্র্য প্রমাণ করে যে মানব জিনোম কতটা অনন্য এবং অজানা রহস্যে ভরা।
সায়েন্স অ্যালার্ট জানিয়েছে, গবেষকরা এখন গোয়াডা নেগেটিভ রক্তের উৎস খুঁজতে চাইছেন। তাদের ধারণা, পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়তো কোনো পরিবারে এমন রক্ত রয়েছে, যা এখনও শনাক্ত হয়নি। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে আরও বিরল রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
এই অভূতপূর্ব রক্তের গ্রুপের আবিষ্কার বিজ্ঞান ও চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, যা মানবজাতির জিনগত বৈচিত্র্যকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সহায়তা করবে।