ছবি : সংগৃহীত
বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, খুন-ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছে, যা দল হিসেবে বিএনপিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। দলের অনেক নেতা মনে করছেন, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও বিএনপি নেতৃত্ব বারবার দাবি করছে যে, কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না এবং অভিযোগ আসা মাত্রই সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
দলের সূত্র মতে, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির ৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো, বহিষ্কার, সতর্ক করা বা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর বিএনপি তীব্র চাপের মুখে পড়ে। এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, এবং বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এ ঘটনায় বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে।
এই ঘটনার পর বিএনপি তাদের তিনটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকে পাঁচজনকে বহিষ্কার করলেও দলটির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চলছেই। বিএনপি নেতারা এই ধরনের প্রচারণাকে পরিকল্পিত ও নোংরা রাজনীতির চর্চা বলে মনে করছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রশ্ন তুলেছেন, "বিভিন্ন মহল এটা নিয়ে হীন রাজনীতির চেষ্টা করছে। তা না হলে ‘তারেক রহমান জবাব দাও’, এই মিছিল কেন?"
গত ৭ জুলাই প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে অন্তত ৫২৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৭৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার ১২৪ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৩০২টি ঘটনায় ২ হাজার ৮৩৪ জনের বেশি আহত এবং ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ১৪০টির বেশি ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে অন্যান্য দলের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ অন্তত ৪০৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৫ জন নিহত এবং এক হাজার ১০৫ জন আহত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা বিএনপির ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পারে। তবে, বিএনপির শীর্ষ নেতারা এই ঘটনাকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত শনিবার একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, "আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, যাকে আমরা স্ক্রিনে দেখেছি, যে হত্যা করছে, তাকে কেন সরকার এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেনি? আমরা কি তবে ধরে নেব, যারা বিভিন্নভাবে মব সৃষ্টি করে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, সেখানে সরকারের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে? প্রশাসনের কোনো প্রশ্রয় আছে?"
তারেক রহমান আরও বলেন, "ষড়যন্ত্র কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমি ৮-৯ মাস আগেই বলেছি, অদৃশ্য শত্রু আছে। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে সেই অদৃশ্য শত্রু। ষড়যন্ত্র আরও জোরেশোরে শুরু হচ্ছে।"
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা নেওয়ার পরও, বিচ্ছিন্ন ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপানো অপরাজনীতি, এটা নোংরা রাজনীতির চর্চা। বিএনপি কোনো অপরাধীকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, কোনোদিন দেবেও না। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপির বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। দলের দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের বিরুদ্ধেও আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আসে। এসব ঘটনায় তখন দল হিসেবে বিএনপিকে বিব্রত হতে হয়েছে। এখন আবার সারা দেশে নেতাকর্মীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ পেতে শুরু করায় দল এবং শীর্ষ নেতৃত্ব বিব্রত।
এই নেতা আরও বলেন, নেতাকর্মীদের এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিএনপির ওপর আগামী সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি দলের প্রতি সাধারণ ভোটারদের আস্থা নষ্ট করছে, বিশেষ করে তরুণ ও নতুন ভোটারদের মাঝে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। এতে করে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে বিএনপি। তবে, দলের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং জনআস্থা ফেরানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে অভ্যন্তরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আসবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশের মানুষ দলীয় প্রতীক ও জাতীয় রাজনীতির অবস্থান দেখে ভোট দেয়। সেই কারণে বলা কঠিন যে এই ধরনের ঘটনাগুলো জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। তবে, এসব ঘটনা নিন্দনীয়।"
তিনি আরও বলেন, "বিএনপি ইতোমধ্যে প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। দল হিসেবে আসলে এর বেশি কিছু করার নেই। কারণ তাদের তো আইন প্রয়োগের সুযোগ নেই। দল কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। বিএনপি যদি বহিষ্কার না করত তাহলে তার দায় থাকত। বহিষ্কার করায় দায় কমেছে।" এই অধ্যাপকের দাবি, "বাংলাদেশে আগে অপরাধীদের দল থেকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ খুব একটা ছিল না। এটা ভালো উদ্যোগ। এখন বিএনপির দায়িত্ব হচ্ছে ভবিষ্যতে এসব অপরাধীরা যেন দলে স্থান না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে দলটি নতুন করে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়তে পারে। তবে এখনই যদি শক্ত হাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে, তাহলে পরিস্থিতি আবার তাদের অনুকূলে যেতে পারে।