ছবি : সংগৃহীত
আজ ১৮ জুলাই ২০২৫, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছর আগের একটি নজিরবিহীন ঘটনার বর্ষপূর্তি। ২০২৪ সালের এই দিনে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই দেশের ডিজিটাল স্পন্দন ইন্টারনেট হঠাৎ করে থেমে গিয়েছিল। প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেট, তারপর ব্রডব্যান্ড—ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল আপন জগৎ থেকে। সেই সময় ইন্টারনেট বন্ধের কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও, সাম্প্রতিক তদন্তে উঠে এসেছে এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা।
গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, "ইন্টারনেট বন্ধ ছিল সরকারের নির্দেশে"। সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) এবং এনটিএমসি (জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টার) এই সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত ছিল। তদন্তে আরও জানা গেছে, তৎকালীন সরকারের দেওয়া ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়া বা সাবমেরিন কেবল কাটা পড়ার অজুহাত ছিল ভিত্তিহীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে জুনাইদ আহমেদ পলক গণহত্যার সব পরিকল্পনার বিষয়ে জানতেন এবং এসব হত্যাকাণ্ডের তথ্য যাতে পুরো বিশ্ব ও দেশের মানুষ না জানতে পারেন, সেজন্যই ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
টানা পাঁচ দিনের ইন্টারনেট শাটডাউন এবং পরবর্তী ধীরগতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে স্টার্টআপ ও ই-কমার্স খাতে, ব্যাপক ক্ষতি হয়। লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে আসে, ২০২৩ সালের ৭১ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪ সালে তা নেমে আসে ৩৫ মিলিয়ন ডলারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রযুক্তি শাটডাউনের কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান। অন্যদিকে, ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব জানিয়েছে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যার বেশিরভাগই প্রথম ১০ দিনে ঘটে।
এছাড়া, আইটি পেশাজীবী ও ফ্রিল্যান্সাররা চরম বিপাকে পড়েন এবং অনেকেই বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন। নেপালের ট্যুরিজম বোর্ড জানিয়েছে, জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে যে ৩৪৭০ পর্যটক প্রবেশ করেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন ছিলেন ফ্রিল্যান্সার।
ইন্টারনেটের সাথে সাথে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ অধিকাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকারপক্ষের মন্ত্রীরা বিশেষ ব্যবস্থায় এসব মাধ্যম ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। ৩১ জুলাই এসব প্ল্যাটফর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলেও তার আগেই বিটিআরসি ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের প্রতিনিধিদের তলব করে, তবে টিকটক ছাড়া কেউ সাড়া দেয়নি।
বর্তমান সরকার ভবিষ্যতে কোনো সরকার যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭ (২) ধারা, যা 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে' ইন্টারনেট সেবা বন্ধের অনুমতি দেয়, তা বাতিল করার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, ৯৭ (২) ধারা বাতিল করা হবে এবং 'কালাকানুন' নয়, নতুন যুগে প্রবেশের সময় এসেছে। তিনি আরও জানান, ইন্টারনেটের দাম কমাতেও বেশকিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং বর্তমান সরকার ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।
এক বছর আগে আন্দোলন থামাতে যখন পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন প্রশ্ন উঠেছিল— প্রযুক্তির এমন নির্ভরশীলতা আর সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরতাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ? সেই বাস্তবতায় এক বছর পর দেশে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক, তখন সেটিকে অনেকেই দেখছেন এক নতুন সম্ভাবনার দরজা হিসেবে। ৪২ হাজার টাকার এককালীন সেটআপ কিট ও সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা মাসিক খরচে মিলবে সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস গতির আনলিমিটেড কানেকশন— তাও কোনো ফাইবার ছাড়াই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক শুধু উচ্চগতির বিকল্প নয়, বরং এটি সরকার নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোর বাইরের একটি স্বাধীন নেটওয়ার্ক, যা ইন্টারনেট অবরোধের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কার্যকর হতে পারে।
এক বছর আগে যেদিন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে গোটা দেশ ডিজিটালভাবে অচল হয়ে পড়েছিল, সেই ১৮ জুলাইকে এবার ভিন্নভাবে স্মরণ করতে চায় সরকার। তাই 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস' উপলক্ষে চলতি বছরের ১৮ জুলাইকে 'ফ্রি ইন্টারনেট ডে' ঘোষণা করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এদিন দেশের সব মোবাইল গ্রাহককে পাঁচ দিন মেয়াদি এক জিবি করে ইন্টারনেট বিনামূল্যে দেওয়া হবে। এটি এক ধরনের প্রতীকী সম্মান ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে— প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারের স্বীকৃতিস্বরূপ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ১৮ জুলাইকে 'ডিজিটাল কালো দিবস' হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আজ থেকে এক বছর আগে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অজুহাতে তৎকালীন সরকার দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত শুধু জনগণের তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করেনি, বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রাকেও থমকে দিয়েছিল।' তিনি আরও জানান, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের 'ঐকমত্য কমিশনে' আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দিয়েছেন।