
ছবি : সংগৃহীত
তুরস্ক তাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান রকেটসান (Roketsan) প্রথমবারের মতো উন্মোচন করেছে “Tayfun Block-4” নামের একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এটি তুরস্কের তৈরি সবচেয়ে দীর্ঘ পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আপডেটেড সংস্করণ, যা দেশটির প্রতিরক্ষা সক্ষমতা কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
রকেটসানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, Tayfun Block-4 ক্ষেপণাস্ত্রটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
এর ওজন: ৭.২ টন বা (২,৩০০ কেজি)
গতি: Mach 5 (ধ্বনির গতির চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুত, অর্থাৎ প্রায় ৬,১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা)
-সর্বোচ্চ পাল্লা হিসাব করলে ৮০০ থেকে ১,০০০ কিলোমিটার (ভবিষ্যতে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে)
এর দৈর্ঘ্য:৬.৫ থেকে ১০ মিটার (মডেলভেদে ভিন্ন)
ব্যাস: ৯৩৮ মিলিমিটার
নির্ভুলতা: ৫ মিটার CEP (Circular Error Probable) অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি ৫ মিটারের মধ্যে আঘাত হানতে সক্ষম
যুদ্ধাস্ত্র: ৭৫০ কেজি ওজনের প্রচলিত বিস্ফোরক বা মডুলার ওয়ারহেড (বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্যবস্তুর জন্য কাস্টমাইজযোগ্য)
Tayfun Block 4 এর রয়েছে হাইপারসনিক গতি: এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতরেই Mach 5-8 গতিতে চলতে পারে এবং মাঝপথে টার্গেট পরিবর্তন করতে সক্ষম, যা একে বর্তমানের যেকোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের জন্য অত্যন্ত কঠিন লক্ষ্য বানিয়ে তোলে ।
রয়েছে গাইডেন্স সিস্টেম। GPS, GLONASS এবং ইনিশিয়াল নেভিগেশন সিস্টেম (INS) এর সমন্বয়ে কাজ করে, যা জিপিএস-বিহীন পরিবেশেও সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে ।
এছাড়াও লঞ্চ প্ল্যাটফর্ম থাকায় , মোবাইল ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার (TEL) থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়, যা ক্ষেপণাস্ত্রটিকে দ্রুত মোতায়েন ও গোপন রাখার সুবিধা দেয় ।
এই ক্ষেপণাস্ত্র তুরস্কের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ:
এটি গ্রিস, সাইপ্রাস, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম।তুরস্কের “মাভি ভাতান” (Blue Homeland) নৌ-কৌশলকে শক্তিশালী করে, যা দেশটিকে ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে ।
ন্যাটো জোটের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে গ্রিস (ন্যাটো সদস্য) এর বিরুদ্ধে এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ।
গ্রিস ও সাইপ্রাস ইতিমধ্যেই এই ক্ষেপণাস্ত্রকে “প্রদর্শনীমূলক হুমকি” বলে আখ্যায়িত করেছে এবং তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আপগ্রেডের কথা ভাবছে ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের এই অস্ত্র উন্নয়নকে “অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ানো” হিসেবে দেখছে ।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এখনও স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি, তবে তুরস্কের সাথে কূটনৈতিক সমন্বয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে ।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন শুধু ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করতে পারে।পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ছে, যার মধ্যে বায়রাক্টার টিবি-২ ড্রোন সরবরাহ ইতিমধ্যেই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে ব্যবহৃত হয়েছে ।
ভারত আশঙ্কা করছে যে, ভবিষ্যতে Tayfun Block-4 এর মতো প্রযুক্তি পাকিস্তানের হাতে গেলে আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য বদলে যেতে পারে ।
বর্তমানে ক্ষেপণাস্ত্রটি সিরিয়াল প্রোডাকশনে রয়েছে, অর্থাৎ বড় আকারে উৎপাদন শুরু হয়েছে ।
রকেটসান ইতিমধ্যেই Cenk মিডিয়াম-রেঞ্জ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিন সংযুক্ত উন্নত সংস্করণ নিয়ে কাজ করছে ।
Tayfun Block-4 এর সাফল্য তুরস্ককে হাইপারসনিক অস্ত্রের বৈশ্বিক ক্লাবে প্রবেশ করিয়েছে, যেখানে আগে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনই আধিপত্য বজায় রেখেছিল। তবে, এই অস্ত্র আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ানোর পাশাপাশি ন্যাটোর ঐক্যেও চাপ তৈরি করতে পারে। তুরস্কের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে, এটি শান্তি নাকি সংঘাতের দিকে এগোবে।